সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় কবিগুরুর চেতনা

সৌম্যদীপ সেনঃ

বিশ্ববরেণ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের অগ্ৰগতির জন্য সংবাদপত্রের গুরুত্ব নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন। বিশেষ করে এ বিষয়ে তাঁর মতামত স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় ১৮৯৮ সালে ইংরেজদের সিডিশন বিল পাসের ঠিক আগের দিন। ঐদিন কলকাতা টাউন হলে ‘কণ্ঠরোধ’ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এর আগে ১৭৯৯ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির শাসনামলে সংবাদপত্র সম্পর্কিত প্রথম রেগুলেশন জারি করা হয়েছিল। ১৮৬০ সালে পেনাল কোড বা দণ্ডবিধি আইন চালু করা হয়, যেখানে মানহানির বিষয়টি স্থান পায় এবং ১৮৭০ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতা স্থান পায়। ১৮৯৮ সালে সংশোধিত আইনে সংবাদপত্রে লেখালেখির মাধ্যমে শ্রেণিশত্রুতা সৃষ্টিকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে ধরা হয়। সময়কাল অনুযায়ী, সিডিশন বিল সংশোধিত হয়ে পাস হওয়ার আগের দিন রবীন্দ্রনাথ তার বক্তব্য রাখেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে হাতে হাতে যে রুটি বিলি হইয়াছিল তাহাতে একটি অক্ষরও লেখা ছিলো না- সেই নির্বাক নিরক্ষর সংবাদপত্রই কি যথার্থ ভয়ংকর নহে। সর্পের গতি গোপন এবং দংশন নিঃশব্দ, সেই জন্যই কি তাহা নিদারুণ নহে। সংবাদপত্র যতই অধিক এবং অবাধ হইবে স্বাভাবিক নিয়মানুসারে দেশ ততই আত্মগোপন করিতে পারিবে না।”
বর্তমান সময়েও বিশ্বকবির এই বক্তব্য প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, সংবাদপত্র শাসন ক্ষমতাকে সুসংহত করতে বন্ধুর মতো ভূমিকা পালন করে। শাসকরা তাদের শাসনকে নির্বিঘ্ন করতে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে চায় কিন্তু তাতে শাসন ক্ষমতার বিশাল জাহাজের ছিদ্রগুলো দেখার সুযোগ বন্ধ হয় বলে দাবি কবিগুরুর।
সংবাদপত্র ঠিক মতো কাজ না করলে গুজব-রহস্য দানা বাঁধে, অজানা আশঙ্কা চেপে বসে শাসকের মনে। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ – “….রুদ্ধবাক সংবাদপত্রের মাঝখানে রহস্যন্ধাকারে আচ্ছন্ন হইয়া থাকা আমাদের পক্ষে বড়ই ভয়ংকর অবস্থা। তাহাতে করিয়া আমাদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ রাজপুরুষের চক্ষে সংশয়ান্ধাকারে অত্যন্ত কৃষ্ণবর্ণ দেখাইবে। অবিশ্বাসে রাজদণ্ড উত্তরোত্তর ক্ষুরধার হইয়া উঠিবে এবং প্রজার হৃদয়ে বিষাদে ভারাক্রান্ত ও নির্বাক নৈরাশ্যে বিষতিক্ত হইতে থাকিবে আমরা ইংরাজের একান্ত অধীন প্রজা। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম তাহার দাসত্ব করে না। আঘাত করিলে আমরা বেদনা পাইব; ইংরাজ হাজার চক্ষু রক্তবর্ণ করিলেও এই নিয়মটাকে দেশান্তরিত করিতে পারিবে না। তাহারা রাগ করিয়া আঘাতের মাত্রা বাগাইতে পারেন। কিন্তু বেদনার মাত্রাও সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়া উঠিবে। কারণ সে বিধির নিয়ম; পেনাল কোডে তাহার কোনো নিষেধ নাই। অন্তঃস্থিত বাক্যে প্রকাশ না হইলে অন্তরে সঞ্চিত হইতে থাকে। সেই অস্বাস্থ্যকর অস্বাভাবিক অবস্থায় রাজা প্রজার সম্বন্ধ কিরূপ বিকৃত হইবে কল্পনা করিয়া ভীত হইতাছি।”
আজ থেকে বহু বছর পূর্বে ইংরেজদের হাতে পরাধীন দেশের প্রজা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। বর্তমানে আমরা স্বাধীন। কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে পরাধীন যুগের চেয়ে কি খুব বেশি স্বাধীন! শাসক ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি করে গণমাধ্যম। সংবাদপত্র শাসক ও আমজনতার মধ্যে আত্মীয় সম্বন্ধ তৈরি করে বলেও মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *