শের সিংহ রানা: এক বিতর্কিত চরিত্রের রাজনৈতিক ও অপরাধজগতের যাত্রা

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

শের সিংহ রানা (মূল নাম: পঙ্কজ সিংহ পানওয়ার) ভারতের সমসাময়িক ইতিহাসের এক রহস্যময়, বিতর্কিত এবং বহুচর্চিত ব্যক্তিত্ব। তিনি একদিকে যেমন অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তেমনি অন্যদিকে একজন আত্মঘোষিত রাজপুত গর্ব এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও পরিচিত। তাঁর নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে বিখ্যাত ডাকাত ও রাজনীতিবিদ ফুলন দেবীর হত্যাকাণ্ড এবং পরে তাঁর বিতর্কিত ‘দেশপ্রেমমূলক’ কার্যকলাপের জন্য।

ফুলন দেবী হত্যা মামলায় জড়িত

২০০১ সালে, উত্তরপ্রদেশের সাবেক সংসদ সদস্য ও ভারতের এক সময়কার সবচেয়ে কুখ্যাত নারী দস্যু ফুলন দেবীকে তাঁর দিল্লির বাসভবনের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। তদন্তে উঠে আসে যে শের সিংহ রানা এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী। আদালতের রায় অনুযায়ী, ফুলন দেবীর মৃত্যু ছিল প্রতিহিংসার ফল—কারণ ফুলন একসময় বহু রাজপুতকে হত্যা করেছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। শের সিংহ রানা নিজেকে রাজপুত জাতির “সম্মানের রক্ষক” হিসেবে দাবি করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটান।

কারাগার থেকে পালানো এবং আফগানিস্তান অভিযান

২০০৪ সালে, রানা দিল্লির তিহার জেল থেকে নাটকীয়ভাবে পালিয়ে যান। এ পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি একেবারে বলিউড সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। পালিয়ে যাওয়ার পরে তিনি আফগানিস্তান চলে যান এবং দাবি করেন, তিনি দিল্লীর শেষ হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের দেহাবশেষ খুঁজে পেতে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, তিনি ঘোর থেকে পৃথ্বীরাজ চৌহানের “অস্থি” ভারতবর্ষে ফিরিয়ে আনেন এবং ‘হিন্দু গৌরব’ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।

ঘোর (Ghor) হল আফগানিস্তানের একটি প্রদেশ 

তবে ঐতিহাসিকদের একাংশ এই দাবিকে ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক নাটক হিসেবে আখ্যা দেন। কেউ কেউ বলেন, এটি ছিল একটি পরিকল্পিত প্রপাগান্ডা যার মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও নির্দোষতার আড়াল তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন রানা।

রাজনীতিতে প্রবেশ

শের সিংহ রানা তার অপরাধমূলক ইতিহাস সত্ত্বেও পরবর্তীকালে “রাষ্ট্রীয় রাজপুত করনি সেনা” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০২২ সালের দিকে তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে রাজপুত স্বার্থে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলবেন।

তিনি আত্মজীবনীও লেখেন—“Jail Diary: Tihar Se Kabul-Kandhar Tak”, যেখানে তিনি নিজের কর্মকাণ্ডের পেছনের যুক্তি, দর্শন এবং অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। বইটি নিয়েও নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

বিতর্ক ও মূল্যায়ন

শের সিংহ রানাকে কেউ একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং রাজপুত গর্বের প্রতীক হিসেবে দেখে থাকেন, আবার অনেকেই তাঁকে একজন সাজাপ্রাপ্ত খুনি ও আত্মপ্রচারপ্রবণ চরিত্র হিসেবেই মনে করেন।

শের সিংহ রানার জীবনচরিত ভারতে রাজনৈতিক অপরাধ, জাতি-সম্মান, প্রতিহিংসা এবং মিডিয়া নাটকের এক চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত। তিনি এখনো রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, কিন্তু তাঁর অতীতের ছায়া তাঁকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ইতিহাসে তিনি থাকবেন এক বিপজ্জনক আদর্শ ও বিতর্কের প্রতীক হিসেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *