
সনাতন সৌঃ
কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। সব পার্বানুষ্ঠানের একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। তাই বাঙালিরা পরব এলেই মেতে ওঠে।এর মধ্যে ভাদু পরবও আছে। ভাদ্র মাস ঢুকতেই রাঢ় বাংলার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান মেদিনীপুর ও মানভূম অঞ্চলে আংশিক বলয় জুড়ে সাড়ম্বরে শুরু হয় ভাদু উৎসব। সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রায় সকলেই জানেন যে, এই উৎসব হচ্ছে একটি লোকদেবী ভাদুকেন্দ্রিক উৎসব। ভাদু পুজোর কোনো মন্ত্র নেই। এই উৎসবে আছে ভাদু নাচ ও গান। অন্য লোক উৎসবের চেয়ে ভাদু চর্চা সময়ের পরিধি একটু বেশি। পুরো একমাস ধরে অনুষ্ঠিত হয় ভাদু উৎসব পর্ব। আর সেই জন্য ভাদু উৎসব গ্রামগঞ্জে শ্রোতা ও দর্শকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভাদু উৎসবে গ্রামের মানুষ মেতে ওঠে। ভাদ্র মাসে গাঁয়ে গাঁয়ে যে বিশেষ গানের প্রচলন আছে তা হচ্ছে ভাদু গান। রাঢ় বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ উপাদান হচ্ছে এই ভাদু গান। ভাদ্র মাসের প্রথমদিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত প্রতহ্য রাতে বাড়ীর কুমারী মেয়েরা, অনেক জায়গায় বিবাহিত নারীরাও সমবেত কণ্ঠে ভাদু গান গেয়ে থাকে। এখন মেয়েদের চেয়ে পুরুষরাই দলবেঁধে বেশি ভাদুগান গেয়ে থাকেন। রাঢ় বাংলায় বিভিন্ন অঞ্চলে ভাদুগানের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ভাদুর মূর্তিকে কোলে নিয়ে গ্রামীণ শ্রমজীবী সঙ্গীত শিল্পীরা গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে ভাদুগান গেয়ে পরবী আদায় করে থাকেন। তাই এই ভাদু গান ও নাচ দেখে উপভোগ করে আনন্দ পায় সকলেই। ভাদু গানে মেতে ওঠে পাড়ার আবহ– তারা গায়– আমার ভাদু ঘরকে এলো,- কোথায় বসাবো?/পাকুড় গাছের ঠাকুর থানে,– আসন সাজাবো।/না না না–ও যে আমাদের সোনার ভাদু,যাদু মণিকে কোলে তুলে নাচাবো। ভাদু লোকদেবী হলেও সে অসিত্বের দিক থেকে কাল্পনিক দেবতা নন। ভাদুকে নিয়ে দুটি কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে, সেই সব রাঢ় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে। একটি হচ্ছে–, কাশীপুরের রাজকন্যা ছিলেন ভাদুমণি। তাঁর অকাল মৃত্যুতে রাজার উদ্যোগে শোক পালনের মধ্য দিয়ে ভাদু উৎসবের সূচনা হয়েছে। ভাদুগানে সেই ইতিহাসের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কয়েকটি ভাদুগানে প্রখ্যাত লোক সঙ্গীত শিল্পী রতন কাহারের কণ্ঠে ফুটে উঠেছে- ১)- কাশীপুরের মহারাজা গো/সে করে ভাদু পূজা,/সন্ধ্যা বেলায় দেয় গো শীতল/কড়কড়ে কলাই ভাজা/হায় হায় গো– /ভাদু নামল দেশে—-। ২) কাশীপুরের মহারাজা করলো আগে ভাদু পুজো গো।—– আবার অন্য লোকশ্রুতি বলে,পঞ্চকোটে সামন্ত রাজা নীলমণি সিং এর পালিতা কন্যা হচ্ছে এই ভাদুমণি। একদা জঙ্গলের মধ্যে কুড়িয়ে পেয়ে কন্যাবত করেছিলেন তাকে। অপরূপ সুন্দরী এই কিশোরী কন্যাটি ছিল খুবই দয়াবতী। তার অমায়িক ব্যবহারে সমস্ত রাজকূল অভিভূত। একদা এক গরীব ব্রাতজনের বাড়ীতে আগুন লাগলে- তা নেভাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় ভাদুমণি। এই মর্মান্তিক ঘটনায় রাজ্যের এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার স্মারক হচ্ছে, ভাদ্র মাসে ভাদু স্মরণ। আর এই স্মরণ্যোৎসবে মিশে যায় দরিদ্র জন সমাজের সুখ দুঃখ, আশা আকাঙ্খার বর্ণমালা। সংযোজিত হয় সমকালীন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। তাই ভাদু গান শুধু আনন্দ ও বিনোদনের উপকরণ নয়, সে যেন সমাজের জলছবিও। দরিদ্র, স্বপ্ল শিক্ষিত সাংস্কৃতিক মানুষদের মনে অনুভবকে খুঁজে পাওয়া যায় ভাদুগানে। এই অনুভবের বিস্ময় আঞ্চলিক বলয়ে উৎসাহে রূপান্তরিত হয়ে যায়। যেমন ভাদুগানে শোনা যায়—১) চল ভাদু দেখতে যাবি, রাণীগঞ্জের বটতলা/সেই সঙ্গে দেখবি ভাদু, কয়লাখাদের জল তোলা।/—-২) সাধের ভাদু তুমি, পূজিব মা তোমার চরণ দুখানি।/ নমঃ নমঃ নমঃ ভাদু নমঃ তোমার চরণে/নিজগুণে কৃপা করো অধম সন্তানে।—- ৩) ওগো, হলো না হলো না, ভাদুর বিয়ে হলো না।/ভাদুর বিয়ে দিবো দেখে যার গাড়ী বাড়ী আছে ।–৪) ভাদু আমার ছোট ছেলে, নাচতে জানে না।—- ৫) সাধের ভাদু তুমি কি যতনে রাখবো আমি —/ভাদুমণি মা জননী গো বাছা,কষা কদম পেড়ো না।পাকলে পরে সবাই খাবে কেউ তো মানা করবে না।—- ৬) আমার ভাদুর বিয়ে দেবো ইস্টিশনের বাবুকে।/আসবে যাবে ভাদু আমার বিনা টিকিটে।—৭) একটি ফুলের জন্য ভাদু করো অভিমান,/ তোমার দুয়ারে দেবো ফুলেরই বাগান।—-এই ভাদু গান রাঢ় বাংলার গর্ব।ভাদুগানে অবিবাহিত কুমারী বাস্তব ব্যথা-বেদনার আর্তি যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি বিবাহিত নারীদের অতৃপ্তি জনিত দুঃখ-কষ্টের, অভাব-অভিযোগের অবস্থাও বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও ওই গানের ভিতর দিয়ে ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে দেশ কালের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থার চিত্রও পাওয়া যায়। এই ভাদু দেবী নন,বাস্তব রক্ত মাংসের নারীও। তাই ভাদু উৎসব এত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে একটি ঐতিহাসিক দিক যেমন আছে, তেমনি গ্রাম বাংলার কোটি কোটি অসহায়-দরিদ্র ও অবহেলিত গণদেবতার ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুয়ারে দুয়ারে হাত পাতা, পুরুষানুক্রমে কাঙালের মতো ভিখারীর জীবন যাপন এসবেরই কাব্যরূপ। গ্রামের সহজ- সরল, সংলগ্ন অসংলগ্ন শব্দ প্রয়োগে বাংলার চিরাচরিত কীর্তন-বাউল, ঝুমুর-লোকগীতি, ফকিরি গানের সুর মাধুর্য্যও এই সব মুখে মুখে ফেরাও তাৎক্ষণিক শব্দ যোজনা ভাদু গানের প্রাণ, তাই ভাদুগান নিয়ে আরও অধিক গবেষণা প্রয়োজন। কারণ গ্রাম বাংলার উন্নয়নে ও সামগ্রিক বিকাশে ভাদুগান সংগ্রহ আজ আমাদের সভ্যতারই জীয়ন কাঠি। বর্তমানে পরিবেশ পরিস্থিতিতে আমাদের গ্রাম্য জীবনে লোকসংস্কৃতিগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। যেভাবে নোংরা রাজনীতির খেলায় গ্রাম্য সহজ সরল গরীবগুর্বো মানুষের মনে ভেজাল বা বিষ ঢোকানো হচ্ছে তাতে তার বিশুদ্ধতা নষ্ট হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর জন্য সকলকে একত্রিত হয়ে সাবধানে মোকাবেলা করতে হবে। যেকোনো মূল্যে সামাজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে।