বীরভূমের গা ঘেঁষে মালুতি: মন্দির, ইতিহাস ও বিস্ময়

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

পাহাড়, অরণ্য আর নদীঘেরা ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার শিকারিপাড়া ব্লকের এক ছোট্ট গ্রাম — মালুতি। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহর থেকে মাত্র ১৬-১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটি এক বিস্ময়কর ঐতিহ্যের ধারক। বাংলার প্রাচীন মন্দিরশৈলী, লোককথা ও ধর্মীয় ইতিহাসকে একত্রে ধারণ করে মালুতি আজও ইতিহাসপ্রেমীদের মুগ্ধ করে।

ঐতিহাসিক পটভূমি
মালুতির ইতিহাস ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে রাজা বসন্ত রায়-এর সঙ্গে, যিনি ১৫শ শতকে এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, নীচু জাতির একজন ধর্মপ্রাণ রাজা হিসেবে তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়ে মালুতিকে রাজধানী করে তোলেন। তাঁর বংশধরেরা পরবর্তী কয়েক শতকে এখানে বহু মন্দির নির্মাণ করেন, যা আজও এখানকার প্রধান আকর্ষণ।

মন্দিরের গ্রাম: ১০৮-এর ঐতিহ্য
মালুতি গ্রামটি প্রাচীনকাল থেকে পরিচিত ছিল “১০৮ মন্দিরের গ্রাম” নামে। যদিও আজ প্রায় ৭২টি মন্দির টিকে আছে, তবুও প্রতিটিই এক একটি স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন। এদের নির্মাণশৈলী বাংলার আটচালা ও একচালা মন্দিরের আদলে, আর অলংকরণে ব্যবহৃত হয়েছে টেরাকোটা শিল্প। মন্দিরগুলিতে প্রধানত শিব, কালী, বিষ্ণু এবং লোকদেবতা ধর্মঠাকুরের পূজা হয়ে থাকে।

টেরাকোটা প্যানেলগুলিতে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, গ্রামীণ জীবন ও যুদ্ধে গৌরবের দৃশ্যাবলি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে — যা একাধারে ধর্মীয়, সামাজিক ও নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকেও অসাধারণ।

উৎসব ও লোকসংস্কৃতি
মালুতি তার ধর্মীয় উৎসবের জন্যও খ্যাত। শিবরাত্রি উপলক্ষে মালুতি মন্দির প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে মেলার কেন্দ্রবিন্দু। ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তেরা আসেন এই মেলায় অংশ নিতে। এছাড়াও দুর্গাপূজা, কালীপূজা এবং স্থানীয় লোকদেবতা পূজার মধ্য দিয়ে মালুতির সংস্কৃতি আজও বেঁচে আছে।

সংকট ও সংরক্ষণের প্রয়োজন
দুঃখজনক হলেও সত্য, মালুতির বেশিরভাগ মন্দির আজ চরম অবহেলায় রয়েছে। অল্প কিছু মন্দির ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে (ASI)-এর তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত, কিন্তু বাকি মন্দিরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও গবেষক মালুতির ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগী হয়েছেন। প্রয়োজন সরকারি স্বীকৃতি, পর্যটনোন্মুখ অবকাঠামো এবং স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

মালুতি আজ শুধুই একটি গ্রাম নয়, বরং বাংলার প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী, ধর্মীয় ইতিহাস এবং লোকজ সংস্কৃতির জীবন্ত নিদর্শন — যেটি ঝাড়খণ্ডের বুকের মধ্যেই একটুকরো “বাংলা”-র মতো রয়ে গেছে। ইতিহাস ও শিল্পপ্রেমীদের জন্য এটি এক অনন্য গন্তব্য, এবং এই ধরণের ঐতিহ্যবাহী স্থানকে সংরক্ষণ করা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *