নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ
বীরভূম জেলার গনপুর অঞ্চলের একটি অনন্য ধর্মীয় ও পর্যটনকেন্দ্র হল শিবপাহাড়ি মন্দির। প্রাকৃতিক শোভা ও ধর্মীয় আবহে মোড়া এই স্থানটি স্থানীয়দের পাশাপাশি বহিরাগত ভক্ত ও পর্যটকদের কাছেও এক আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এই মন্দির ঘিরে বহু পুরাতন ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনি জড়িয়ে আছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও পৌরাণিক জনশ্রুতি
শিবপাহাড়ি মন্দিরের ইতিহাস বহু শতাব্দী পুরোনো। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই স্থানে এক সময় মহাভারতের অন্যতম চরিত্র জয়দ্রথ তপস্যা করেছিলেন। তিনি ছিলেন কৌরবদের সমর্থক ও কাশীরাজের জামাতা, যিনি অভিমন্যুর মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী ছিলেন। মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অভিমন্যুকে চক্রব্যূহে ফাঁসিয়ে হত্যা করার পর, পাণ্ডবরা বিশেষ করে অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেন যে, পরের দিন সূর্যাস্তের পূর্বে তিনি জয়দ্রথকে বধ করবেন, নচেত আত্মহত্যা করবেন। এই জনশ্রুতি অনুযায়ী, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বহু পূর্বে জয়দ্রথ এই শিবপাহাড়ি অঞ্চলে এসে কঠোর তপস্যা করেন মহাদেবকে সন্তুষ্ট করার জন্য। ভগবান শিব তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর দেন, যে তিনি একদিনের জন্য পাণ্ডবদের সবাইকে রুখে দিতে সক্ষম হবেন – এই বরই পরবর্তীকালে চক্রব্যূহ রচনায় ব্যবহৃত হয়।
স্থানীয়দের মতে, শিবপাহাড়ির এই নির্জন পাথুরে পর্বত ও গভীর বনে জয়দ্রথ দিনের পর দিন উপবাসে কাটান, কেবলমাত্র শিবের কৃপা পাওয়ার জন্য। আজও মন্দিরের পাশে একটি গুহার মতো স্থানকে “জয়দ্রথের তপস্যাস্থল” বলে সম্মান করা হয়।

অবস্থান ও পরিবেশ
শিবপাহাড়ি মন্দিরটি অবস্থিত বীরভূম জেলার গনপুর অঞ্চলে, শান্তিনিকেতন থেকে কিছুটা দূরে। চারিদিকে সবুজ বনাঞ্চল, শাল-পিয়াল ও মহুয়া গাছের ছায়ায় ঢাকা এই স্থানটি প্রকৃতি ও নিস্তব্ধতাকে একসাথে উপভোগ করার এক অসাধারণ সুযোগ এনে দেয়।
ধর্মীয় গুরুত্ব
মন্দিরটি মহাদেব বা শিবের উপাসনাস্থল। এখানে একটি প্রাচীন শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে, যা অনেকেই স্বয়ম্ভু বলে বিশ্বাস করেন। প্রতি বছর মহাশিবরাত্রি, শ্রাবণ মাসের সোমবার, ও অমাবস্যার দিনগুলিতে এখানে বিশেষ পূজা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা এসে পুণ্যস্নান, আরাধনা ও ব্রত পালন করেন।
স্থাপত্য ও গঠন
মন্দিরটি খুব জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও, প্রাকৃতিক পাথর ও স্থানীয় উপকরণে নির্মিত। পাহাড়ের গায়ে গড়ে উঠেছে বলে এটি একটি প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা স্থাপত্যের নিদর্শন। মন্দির চত্বরের চারপাশে বন্যপ্রাণী ও পাখির বসবাস রয়েছে, যা পরিবেশকে আরও মাধুর্যপূর্ণ করে তোলে।
পর্যটকদের আকর্ষণ
এখানে এসে শুধু পুজো নয়, বরং প্রকৃতি প্রেমীরাও খুঁজে পান মানসিক প্রশান্তি। পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটা, পাখির ডাক শোনা, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা—সব কিছু মিলিয়ে এক দিব্য অভিজ্ঞতা। অনেকেই এখানে এসে একান্তে ধ্যান ও যোগচর্চা করেন। ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে জয়দ্রথের তপস্যার স্থান হিসেবে এটি এক ভিন্নমাত্রার আকর্ষণ।
যাত্রাপথ
গনপুরে পৌঁছানোর পর স্থানীয় গাড়িতে বা হেঁটেও শিবপাহাড়ি মন্দিরে যাওয়া যায়। রামপুরহাট, বোলপুর বা সাঁইথিয়া থেকে বাস বা ট্রেনে গনপুরে এসে সহজেই এই মন্দির পরিদর্শন করা যায়।
শিবপাহাড়ি মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়—এটি ইতিহাস, পৌরাণিকতা, প্রকৃতির সৌন্দর্য, লোকবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার মিলনস্থল। মহাভারতের মতো প্রাচীন কাহিনির সঙ্গে এই স্থানের যোগসূত্র আমাদের কল্পনার জগৎকে বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে জুড়ে দেয়। এমন একটি স্থান, যেখানে হাজার বছরের পুরোনো কাহিনি আজও স্থানীয় মানুষদের স্মৃতিতে জীবন্ত। এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলির সংরক্ষণ ও প্রচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
